২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

ওয়াজ মাহফিলে ছয় দফা বিধিনিষেধ!

ওয়াজ মাহফিলে ছয় দফা বিধিনিষেধ! - সংগৃহীত

এক গ্রামে ওয়াজ মাহফিল হবে। সেখানে খ্যাতনামা আলেম ওলামা আসবেন। সেই গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর আছেন। গ্রামের লোকেরা চাইল, তিনি সেখানে যেন প্রধান অতিথি হন। এখনকার রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী পদাধিকার বলে ক্ষমতাসীন দলের সভাপতি অথবা স্থানীয় কর্তাব্যক্তি-চেয়ারম্যান/মেয়র বা এমপির উপস্থিতি অনিবার্য। সুতরাং, ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের নাম ছাপা হলো সভাপতি হিসেবে। পোস্টার যখন ছাপা হলো তখন এক পাতি নেতা বাদ সাধলেন। তিনি বললেন, ‘চেয়ারম্যান বড়, নাকি প্রফেসর বড়? প্রফেসর তো জনপ্রতিনিধি নয়। সুতরাং এই পোস্টার লাগানো যাবে না। নেতার অবমাননা আমরা সহ্য করব না।’ অবশেষে ওই ওয়াজ মাহফিল আর হতে পারেনি।

ঝালকাঠি থেকে একজন উকিল আমাকে একটি পোস্টার পাঠালেন। সেখানে প্রধান অতিথি মন্ত্রী মহোদয়। প্রধান বক্তা হিসেবে একজন আলেমের নামসহ কয়েকজন হুজুরের নাম গুরুত্বহীনভাবে ছাপা হয়েছে। বিশেষ অতিথির ‘ছড়াছড়ি’। সেখানে পাশের এলাকার এমপির নাম আছে। স্থানীয় মেয়র, এমনকি কমিশনারের নাম বড় করে লেখা আছে। সেই সাথে তাদের দলে পদ ও পদবি যথার্থভাবে উল্লেখ আছে। উকিলের প্রশ্ন, এটা কি রাজনৈতিক জনসভা’ নাকি ওয়াজ মাহফিল?


একটি মসজিদ কমিটি গঠনের সভা হচ্ছে। উপস্থিত মুসল্লিরা চাচ্ছেন, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজি ব্যক্তিরা কমিটিতে থাকুন। কিন্তু একজন বিশিষ্ট রাজনৈতিক ব্যক্তি নিজেই সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ও কোষাধ্যক্ষসহ প্রায় সব পদে নাম প্রস্তাব করলেন। এর মধ্যে তাদেরই নাম বেশি যারা কালেভদ্রে মসজিদে আসেন। লোকজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। কেউ একজন ক্ষীণকণ্ঠে বলল, অমুক তো মসজিদে আসেন না। নেতা ধমক দিয়ে বললেন, মসজিদের উন্নয়ন চাইলে ওকে লাগবে। মসজিদ কমিটির ১৭ নম্বর সদস্য হিসেবে একজন দ¦ীনদার মানুষের কথা বলা হলো। তিনি সরকারবিরোধী পক্ষের লোক। অমনি ক্ষেপে উঠলেন সেই নেতা। ‘তোমরা কি মসজিদের সর্বনাশ করতে চাও?’ সুতরাং বিনা বাক্যব্যয়ে তাদের নিয়ে মসজিদ কমিটি গঠিত হলো। উল্লেখ্য, তারা সবাই ক্ষমতাসীন দলের লোক।

এভাবে রাজনৈতিক কর্তৃত্বের পাশাপাশি সব প্রতিষ্ঠান- হাটবাজার, ক্লাব, সমিতি, স্কুল, কলেজ, মাদরাসা এমনকি মসজিদ কমিটি পর্যন্ত চলছে দলীয়করণ। রাজনীতি নির্বাসনে, অর্থনীতিতে অবাধ লুটপাট, সামাজিকতা উপেক্ষিত, আইন-কানুন পদদলিত এবং সাংস্কৃতিক অঙ্গনে অশ্লীলতা জেঁকে বসেছে। আগুন চারদিকে। ধর্ষণ এবং নারীর ঝলসানো মুখ সর্বত্র। এ অবস্থায় দ্বীনের আলোর অন্বেষায় মানুষ উন্মুখ। এ অবস্থায় ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে উপচেপড়া ভিড়- এমনকি বেশরিয়তি জলসায়ও। এর মাঝে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় হক্কানি আলেম ওলামার ওয়াজ মাহফিলের কথা।

সুদীর্ঘকাল ধরে গ্রামগঞ্জে, শহরে বন্দরে, দেশের আনাচে-কানাচে ওয়াজ মাহফিল চলে আসছে। আলেম ওলামা মানুষের হেদায়েতের উদ্দেশ্যে, মানুষের সংশোধনের জন্য এবং সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের জন্য বয়ান করে থাকেন। এখানে শুধু আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলের কথা বলা হয়ে থাকে। কখনো কখনো রাজনীতি প্রাসঙ্গিক উদাহরণ হিসেবে এসে যায়। এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তিবিদ্বেষ বা ব্যক্তির প্রশংসা অনুপস্থিত। তবে উল্লিখিত রাজনৈতিক ওয়াজ মাহফিলের কথা আলাদা। অনেকে ধর্মকেও সাম্প্রদায়িকতাকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। নাস্তিক পর্যন্ত টুপি মাথায় দেয়। হজ করে। নেতারা বিদ্যার দৌড় মাফিক ইসলামের কথা বলেন। কখনো কখনো ‘মদিনার সনদ’ অনুযায়ী দেশ শাসনের কথা বলা হয়। আবার প্রয়োজনে রক্তনদী বইয়ে দিতেও দ্বিধা করা হয় না। সবই ক্ষমতার রাজনীতির ‘মাহাত্ম্য’।


যখন আলেম ওলামা কথা বলেন তখন সেখানে মহান আল্লাহর প্রশস্তি ছাড়া আর কিছু থাকে না। তারা ব্যক্তির প্রশস্তিতে বিশ্বাস করেন না। আগে যাত্রাপালায় প্রথমে ‘বন্দনার’ বিধান ছিল। সেখানে বিধাতা, গুরু ও মালিকপক্ষের প্রশস্তি থাকত। এখানে যখনি আপনি ক্ষমতাসীন মহলের কোনো নেতার বয়ান শুনবেন তখন লক্ষ করবেন- শুরুতে প্রশস্তি, শেষেও প্রশস্তি। কিন্তু ওয়াজ মাহফিলে ব্যক্তির বন্দনা নেই। প্রশস্তির অবকাশ নেই। আর সেজন্য মনে হয় ইদানীং আলেম সমাজের ওপর বেজায় ক্ষিপ্ত হয়েছে মহল বিশেষ। শত শত বছর ধরে, ব্রিটিশ আমল থেকে আলেম ওলামা ওয়াজ করছেন। কোনো দিন তাদের ওপর কোনো বিধিনিষেধ আরোপিত হয়নি।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওয়াজ মাহফিল নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নিয়েছে। তারা ছয়টি নির্দেশনা দিয়েছেন। ০১. ওয়ায়েজ হুজুররা যেন বাস্তবধর্মী ও ইসলামের মূল স্পিরিটের সাথে সংহতিপূর্ণ বক্তব্য দেন, সেজন্য তাদের প্রশিক্ষণ ও উদ্বুদ্ধকরণের ব্যবস্থা করা। এ ক্ষেত্রে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে স্থানীয় প্রশাসন ও কমিউনিটি পুলিশের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ; ০২. যারা ওয়াজের নামে হাস্যকর ও বিতর্কিত বক্তব্য দেয়ার মাধ্যমে ধর্মের ভাবগাম্ভীর্য নষ্ট করার চেষ্টা চালান, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ প্রো-অ্যাকটিভ উদ্ধুদ্ধকরণ; ০৩. অনেক আলেমের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রির মতো উচ্চশিক্ষা ছাড়া যারা ওয়াজ করেন, তারাই জঙ্গিবাদ ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তাই মাদরাসায় উচ্চশিক্ষিত ওয়াজকারীদের নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসা;

০৪. অনেকেই আছেন, যারা হেলিকপ্টারযোগে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দেন এবং ঘণ্টাচুক্তিতে বক্তব্য দিয়ে বিশাল অঙ্কের অর্থ নেন। তারা নিয়মিত ও সঠিকভাবে আয়কর দেন কিনা, তা নজরদারির জন্য আয়কর বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব বিভাগের তৎপরতা বৃদ্ধি করা; ০৫. ওয়ায়েজ হুজুরদের বক্তব্য স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক সংরক্ষণ ও পর্যালোচনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া এবং উসকানিমূলক ও বিদ্বেষ ছড়ানো হলে তাদের সতর্ক করা। প্রয়োজনে পরবর্তী সময়ে তাদের ওয়াজ করার অনুমতি না দেয়া এবং ০৬. সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে রাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দেয়া ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনা।

বাংলাদেশের নাগরিকেরা অবগত আছেন যে, বিগত ১২ বছরে বর্তমান শাসক দলের শাসনের সূচনাকাল থেকে এ পর্যন্ত নানা ধরনের নিবর্তনমূলত কালো আইন তৈরি করে বাক-স্বাধীনতা অনেকাংশেই খর্ব করা হয়েছে। প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট, নিরাপত্তা আইন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন ইত্যাদি নানা কৌশলে নাগরিকদের মৌলিক স্বাধীনতা লুপ্ত প্রায়। ভুয়া সংবাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগের মাধ্যমে অবশিষ্ট মৌলিক অধিকারও কেড়ে নেয়ার প্রয়াস চলছে। রাগ, দুঃখ ও ক্ষোভের কারণে যেসব নাগরিক অভিযোগ, অনুযোগ ও মন্তব্য করেছেন তাদের আইনের আওতায় আনা হয়েছে। অনেকে জেল-জুলুম ও হয়রানির মধ্যে অবস্থান করছে। এখন ওয়াজ মাহফিল সম্পর্কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিধিনিষেধও এরকম একটি কালাকানুন বলে মনে করা হতে পারে।

এটা এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে আইনকানুন ও বিধিনিষেধ আরোপের কোনো ক্ষেত্র বা কারণ নেই। যারা ঘুষ, দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদেরও কি স্তব্ধ করতে চায় সরকার? তারা স্বীকার করেছেন যে, ওয়াজ মাহফিলগুলোও সরকারের এজেন্সিগুলো তদারক করছে। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ‘ওয়াজ মাহফিলে কে কোথায় কী বলেন, তা আমরা সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা দফতর থেকে পেয়ে আবার বিভিন্ন জায়গায় পাঠানো হয়।’ ওয়াজ মাহফিল মনিটরিংয়ের কথা এ দেশে এবারই প্রথম জানা গেল। অতীতের আওয়ামী লীগের আমলে এ ধরনের ব্যবস্থার কথা জানা যায়নি। তার মানে হচ্ছে, সরকার ভিন্ন মত পোষণের কোনো সুযোগ দিতে চাচ্ছে না। এটা প্রমাণ করে, সরকার প্রতিনিয়ত জনভীতিতে ভুগছে। একটি গণবিরোধী সরকার যখন বুঝতে পারে জনসাধারণ তাদের বিরুদ্ধে চলে গেছে এবং শুধু তারা গায়ের জোরে পুলিশে ভর করে টিকে আছে, কেবল তখন তাদের এ ধরনের আচরণ পরিলক্ষিত হতে পারে।

একটি নীতিগত প্রশ্ন উত্থাপন করা যায়। আর তা হলো ওয়ায়েজরা কি ভুল বললেন, নাকি শুদ্ধ বললেন, তা নির্ধারণের নৈতিক ও আইনগত অধিকার কর্তৃপক্ষের আছে কিনা। আজকের যুগটা স্পেশালাইজেশন বা বিশেষ জ্ঞানের যুগ। আমলারা প্রশাসনের বিষয়ে ভালো বোঝেন, প্রকৌশলীরা কারিগরি বিষয়টি জানেন, চিকিৎসকেরা মানবদেহ সম্পর্কে অবগত। চোখে ব্যথা হলে নিশ্চয়ই আপনি দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাবেন না। সেরূপ, আলেম ওলামা হলেন আধ্যাত্মিকতার ডাক্তার। দুনিয়ার জীবন কিভাবে কুরআন ও সুন্নাহ অনুযায়ী গঠন করতে হবে তা নিশ্চয় তাদের কোনো মন্ত্রণালয় থেকে শিখতে হয় না। আর কোনটি হাস্যকর আর কোনটি বিতর্কিত, তা নির্ধারণের জ্ঞান ও যোগ্যতা প্রসাশনের থাকার কথা নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কথা বলা হয়েছে- পৃথিবীর জ্ঞানী মানুষদের অনেকেই সার্টিফিকেটের ধার ধারেন না। যারা আসলেই জানেন তারা জনসমক্ষে কথা বলার সাহস রাখেন। ডিগ্রিবিশেষ কিংবা পিএইচডি কোনো ব্যক্তির মৌলিক শিক্ষার জন্য অপরিহার্য নয়। প্রসঙ্গত বলছি, সাম্প্রতিককালে সরকার দাওরায়ে হাদিসকে সর্বোচ্চ ডিগ্রির সম্মান দিয়ে গোড়া কেটে গাছের ডগায় পানি দিয়েছেন বলে বেশির ভাগ আলেমের ধারণা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই আদেশে বলা হয়েছে, ‘দাওরায়ে হাদিস ডিগ্রির মতো উচ্চশিক্ষা ছাড়া যারা ওয়াজ করেন তারাই জঙ্গিবাদ ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছেন। তাই মাদরাসায় উচ্চ শিক্ষিত ওয়াজকারীদের নিবন্ধনের তালিকায় নিয়ে আসা।’ এ বক্তব্যকে এই মর্মে চ্যালেঞ্জ করা যায় যে, এত দিন যারা জঙ্গিবাদের নামে অভিযুক্ত ও গ্রেফতার হয়েছে তাদের মধ্যে ক’জন আলেম? তাদের প্রায় সবাই কি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত নয়? সুতরাং রাজনৈতিক বা অন্যকোনো উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য একের বদনাম অপরের ঘাড়ে দেয়া অবশ্যই ন্যায়। নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার অর্থ হচ্ছে সরকারের বাধ্যগত এক ধরনের স্তাবক তৈরি করা। হেলিকপ্টারে মাহফিলে গমনে এবং কথিত বিশাল অঙ্কের অর্থ গ্রহণ প্রসঙ্গে। রাজনীতিক ও অন্যান্য ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ব্যাপারে সরকারে বক্তব্য কোথায়? হেলিকপ্টারযোগে সাধারণত যারা যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন, তারা আলেম নয়। বিশাল অঙ্কের কথা তোলা হয়েছে। কত টাকা হলে ‘বিশাল’ হয়? ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা লুটপাটের চেয়েও কি বেশি? এটা যারা ইসলামের বিরোধিতা করেন, তারা কৌশলগতভাবে দরদি ভাব ও ভাষা দিয়ে প্রকারান্তরে কার্যসিদ্ধি করেন।

এ কৌশলটি অবশ্য অনেক পুরনো। আরব বিশে^ নাসের, সাদ্দাম, বাশার আল আসাদরা ইসলামকে জাতীয়করণের উদ্দেশ্যে ‘রাষ্ট্রীয় ধর্ম’ করে জনগণকে ধাপ্পা দিতে চেয়েছেন। এর অর্থ সরকার যে ইসলামের কথা সরকারিভাবে বলবে ও প্রচার করবে, সেটিই খাঁটি ইসলাম। অন্যরা অন্য কোনোভাবে ইসলাম প্রচার করতে পারবেন না। এমনকি ওই সব দেশে তাবলিগও নিষিদ্ধ। এরশাদ যখন ‘রাষ্ট্রধর্ম’ ঘোষণা করেছিলেন। তখন তিনি বলেছিলেন, সম্ভাব্য ইসলামী শক্তির উত্থান ঠেকাতেই তিনি তা করছেন। বাংলাদেশে ‘ইসলামিক ফাউন্ডেশন’ আছে। বিগত এক যুগে এর প্রকাশনার দিকে তাকিয়ে দেখা যায় এটা কতটা ইসলামিক আর কতটা প্রশস্তিমূলক। জাতীয় মসজিদও প্রশস্তির আগারে পরিণত করার চেষ্টা হয়েছে। কিছু অতি উৎসাহী লোক সর্বত্রই রয়েছেন। তারাই ব্যক্তিবিশেষের নামে খুতবা পাঠের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ক্ষমতাবানেরা এদের লালন পালন করে, কাজে লাগায়। কিন্তু স্বীকৃতি দিতে চায় না।

আলেম ওলামার একটি অংশ সরকারের পক্ষে ফতোয়া দিচ্ছে এবং বন্দনা গাইছে। ইতিহাসে এ পর্যন্ত সব আমলেই তাদের অস্তিত্ব ছিল এবং থাকবে। তাই বলে কখনো হক্কানি আলেমদের মর্যাদা ও সম্মান ক্ষুণœ হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চিহ্নিত ১৫ জন আলেমের তালিকা দ্বীনদার ব্যক্তিকে মর্মাহত করবে। তার কারণ ১৫ জনের প্রায় সবাই সারা দেশে দ্বীনদার ও পরহেজগার আলেম হিসেবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত। একজন কথিত পীর বাদে সবাই সমধিক শ্রদ্ধেয়। বিশেষ করে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির, চরমোনাইয়ের সাহেবজাদা মুফতি ফয়জুল করীমের নাম তালিকায় দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। তিনি লাখ লাখ মানুষের হৃদয় জয় করা ব্যক্তিত্ব। তার বক্তব্য সাধারণ মানুষের জন্য এক ধরনের পাথেয়। তার আবেগময় বক্তব্য মানুষকে দ্বীনের পথে ধাবিত করছে। রাজনীতির কারণে যদি তিনি চিহ্নিত হন তাহলে রাজনৈতিক উপায়েই এসব সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত, ওয়ায়েজিন হিসেবে নয়।

এ ধরনের পদক্ষেপ অন্যায়, অনভিপ্রেত এবং অগ্রহণযোগ্য। আমাদের সমাজে ইসলামের যতটুকু আজো আছে, আলেম ওলামার কারণেই তা রয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘অতএব তুমি তাদের উপদেশ দিতে থাকো। কেননা উপদেশ ঈমানদারদের উপকারে আসে’ (সূরা : জারিয়াত, আয়াত : ৫৫)। মানুষকে উপদেশ দেয়া আলেম সমাজের নৈতিক দায়িত্ব। এ পথে কোনো রকম বিধিনিষেধ আরোপ করা তাদের মৌলিক অধিকারে হস্তক্ষেপের শামিল। যারা ঈমান ও ইসলামের কথা সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরছেন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা সঙ্গত নয়। আশা করি, সরকার অহেতুক জনমনে ক্ষোভ বৃদ্ধি করবে না। ওয়াজ মাহফিল নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হলে কার্যত সমাজের অনৈতিকতার আরো প্রসার ঘটবে। আলোকিত মানুষ ও আলোকিত জাতি গড়ার জন্য আলেম সমাজের ভূমিকা অপরিহার্য। বিখ্যাত গ্রন্থ ‘সিয়াসত নামা’-এর লেখক বিশেষ সুপরিচিত জ্ঞানী ব্যক্তি নিযামুল মুলকের একটি মন্তব্য দিয়ে শেষ করি। তিনি বলেন, ‘প্রকৃত আলেম সেই, যে নিজকে শাসক থেকে দূরে রাখে, আর প্রকৃত শাসক সেই, যে প্রকৃত আলেমের সান্নিধ্য কামনা করে।’

লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় 
Mal55ju@yahoo.com


আরো সংবাদ



premium cement